ইসলামে ছবি বা মূর্তি বানানো জায়েজ? দলিল সহ বিস্তারিত আলোচনে কর। যদি জায়েজ হয় কিকি শর্তে জায়েজ ?
ইসলামে ছবি বা মূর্তি বানানোর বিষয়ে দলিলভিত্তিক আলোচনা করতে হলে কুরআন, হাদিস, এবং প্রাচীন ও আধুনিক ফকিহদের দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনা করতে হবে। এ বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি বেশ স্পষ্ট, তবে কিছু নির্দিষ্ট শর্তের আওতায় বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।
১. ছবি ও মূর্তি সম্পর্কে ইসলামের সাধারণ অবস্থান
ইসলামে ছবি ও মূর্তি তৈরির বিষয়ে মূলত দুইটি দিক বিবেচনা করা হয়:
- মূর্তি তৈরি বা উপাসনা করা:
সরাসরি হারাম, কারণ এটি শিরকের দিকে ধাবিত হতে পারে। - চিত্রাঙ্কন বা ছবি তৈরি:
নির্দিষ্ট শর্তসাপেক্ষে জায়েজ হতে পারে, বিশেষ করে যেখানে জীবন্ত প্রাণীর ছবি থাকে না।
কুরআনের দলিল
১. মূর্তি তৈরি নিষিদ্ধ
কুরআনে আল্লাহ বলেছেন:
"তোমরা মূর্তি তৈরি করো না এবং তা পূজা করো না।"
(সূরা আন-নাহল: ৩৬)
২. শিরক থেকে বিরত থাকার নির্দেশ
আল্লাহ তাআলা বলেন:
"নিশ্চয়ই আল্লাহ শিরক ক্ষমা করেন না এবং এর চেয়ে কম অপরাধ ইচ্ছা করলে ক্ষমা করেন।"
(সূরা আন-নিসা: ৪৮)
→ মূর্তি ও জীবন্ত প্রাণীর ছবি বানানো মানুষকে শিরকের দিকে নিয়ে যেতে পারে বলে এটি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
হাদিসের দলিল
১. মূর্তি ও প্রাণীর ছবি নিষিদ্ধ
নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:
"যারা জীবন্ত প্রাণীর ছবি বানায়, কিয়ামতের দিন তাদেরকে শাস্তি দেওয়া হবে। তাদের বলা হবে, যা তৈরি করেছ, তা জীবিত করো।"
(সহিহ বুখারি: ৫৯৫৪, সহিহ মুসলিম: ২১০৮)
২. ঘরে ছবি রাখার বিষয়ে সতর্কতা
হাদিসে এসেছে,
"যে ঘরে ছবি থাকে, সে ঘরে ফেরেশতারা প্রবেশ করে না।"
(সহিহ বুখারি: ৫৯৫৭, সহিহ মুসলিম: ২১০৬)
৩. মূর্তির বিরুদ্ধে হাদিস
নবিজী (সা.) মক্কা বিজয়ের সময় কাবা শরীফে থাকা মূর্তিগুলো ভেঙে দেন এবং বলেন:
"সত্য এসেছে এবং মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে।"
(সহিহ বুখারি: ২৪৭৮)
→ এটি দেখায় যে, মূর্তি ইসলামি সমাজে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
২. ছবি বা মূর্তি কখন জায়েজ হতে পারে?
কিছু নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে, বিশেষ শর্তে ছবি বা চিত্রকর্ম জায়েজ হতে পারে। ফকিহরা নিম্নলিখিত অবস্থাগুলোকে ব্যতিক্রম হিসেবে উল্লেখ করেছেন:
জায়েজ অবস্থাগুলো
-
অজীব জিনিসের ছবি:
গাছপালা, পর্বত, নদী, প্রকৃতির ছবি আঁকলে বা বানালে কোনো সমস্যা নেই। এটি সব মাজহাবেই বৈধ। -
প্রয়োজনীয় জিনিসে ছবি:
- শিক্ষা, চিকিৎসা, বা নিরাপত্তার জন্য তৈরি চিত্র বা ছবি জায়েজ।
- উদাহরণ: পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্র, চিকিৎসার জন্য শরীরের অংশের ছবি ইত্যাদি।
-
শিশুদের খেলনা:
নবিজী (সা.) আয়েশা (রা.)-এর জন্য কিছু খেলনা ও পুতুল রাখতে অনুমতি দিয়েছিলেন।
হাদিস:
"আমি (আয়েশা) খেলনা রাখতাম এবং নবিজী আমাকে তা থেকে বিরত করতেন না।"
(আবু দাউদ: ৪৯৩২) -
ডিজিটাল চিত্র বা ছবি:
আধুনিক আলেমদের মতে, ডিজিটাল চিত্র (যেমন টেলিভিশন, মোবাইল বা ক্যামেরার ছবি) হারাম নয়, কারণ এটি কাগজে স্থায়ী নয় এবং এটি বাস্তব ছবি কেবল প্রদর্শন করে।
নিষিদ্ধ অবস্থাগুলো
-
জীবন্ত প্রাণীর ছবি বা মূর্তি বানানো:
ইসলামে এটি সাধারণত নিষিদ্ধ, কারণ এটি অহংকারের দিকে ধাবিত হতে পারে এবং মানুষকে আল্লাহর সৃষ্টিকে অনুকরণের দিকে নিয়ে যেতে পারে। -
ইবাদতের উদ্দেশ্যে মূর্তি বা ছবি বানানো:
এটি সরাসরি শিরকের মধ্যে পড়ে এবং সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। -
ঘরে স্থায়ীভাবে ছবি রাখা:
জীবন্ত প্রাণীর ছবি বা মূর্তি ঘরে রাখা হলে ফেরেশতারা প্রবেশ করে না। -
নগ্ন বা অশ্লীল ছবি:
যেকোনো ধরণের অশ্লীল বা অনৈতিক ছবি তৈরি বা প্রদর্শন সম্পূর্ণ হারাম।
৩. আধুনিক দৃষ্টিকোণ
প্রযুক্তিগত ছবি:
- আলেমদের মতে, প্রযুক্তিগত ছবি যেমন ফটোগ্রাফি, সিনেমা বা ভিডিও তৈরি জায়েজ হতে পারে, যদি এগুলো ইসলামের সীমার মধ্যে থাকে।
প্রযুক্তি ব্যবহার শর্তসাপেক্ষে জায়েজ:
- যদি ছবি বা ভিডিও হারাম কার্যকলাপ (যেমন, নগ্নতা, অশ্লীলতা) প্রচার না করে।
- যদি এটি শিক্ষামূলক, ধর্মীয় বা বৈধ কাজে ব্যবহৃত হয়।
উপসংহার
-
মূর্তি:
মূর্তি তৈরি বা রাখার কোনো অবস্থাতেই ইসলামে অনুমতি নেই। এটি শিরকের দিকে ধাবিত হতে পারে বলে সম্পূর্ণ হারাম। -
ছবি:
অজীব জিনিসের ছবি, ডিজিটাল ছবি, শিক্ষামূলক বা প্রয়োজনীয় কাজে ছবি ব্যবহার শর্তসাপেক্ষে জায়েজ। তবে জীবন্ত প্রাণীর ছবি বা অশ্লীল ছবি তৈরি করা হারাম।
সতর্কতা:
ছবি ও চিত্রকর্মে ইসলামের সীমারেখা মেনে চলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি কাজের জন্য নিয়ত বিশুদ্ধ রাখা এবং আল্লাহর হুকুমের প্রতি আন্তরিক হওয়া আবশ্যক।
প্রস্তাবনা:
সন্দেহপূর্ণ কাজ এড়িয়ে চলুন এবং কোনো বিষয়ে নিশ্চিত হতে অভিজ্ঞ আলেমদের পরামর্শ নিন।