হানফি মাজহাব মতে ইসলাম ধর্মে নবিজীর জন্মদিন পালন করা কি জায়েজ ?
নবিজীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জন্মদিন উদযাপন বা "মীলাদুন্নবী" পালন সম্পর্কে দলিল-ভিত্তিক আলোচনা করতে হলে ইসলামের প্রধান উৎস কুরআন ও হাদিস, এবং সাহাবা, তাবেয়ীন ও পরবর্তী ফকিহদের বক্তব্যগুলো বিবেচনায় নিতে হবে। এখানে বিষয়টি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো:
১. কুরআনের দৃষ্টিকোণ
কুরআনে নবিজীর জন্মদিন পালন সম্পর্কে সরাসরি কোনো নির্দেশনা নেই। তবে নিম্নলিখিত আয়াতগুলো মীলাদ পালনের পক্ষে দলিল হিসেবে পেশ করা হয়:
পক্ষে দলিল:
-
নবিজীর আগমন আল্লাহর রহমত:
আল্লাহ বলেন:
"আর আমি আপনাকে (হে মুহাম্মাদ) সমগ্র বিশ্বের জন্য রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছি।"
(সূরা আল-আম্বিয়া: ১০৭)
→ এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, নবিজীর আগমন মানবতার জন্য এক বড় নেয়ামত। এ কারণে তাঁর জন্মদিনে আনন্দ করা বৈধ হতে পারে। -
আল্লাহর অনুগ্রহে আনন্দ করা:
আল্লাহ তাআলা বলেন:
"বলুন, এটি আল্লাহর অনুগ্রহ এবং তাঁর রহমতে—তাতেই তারা আনন্দিত হোক।"
(সূরা ইউনুস: ৫৮)
→ অনেকে মনে করেন, নবিজীর জন্মদিনে আনন্দ করা আল্লাহর অনুগ্রহে শোকরিয়া আদায় করার একটি উপায়।
বিপক্ষে দলিল:
-
সরাসরি কোনো প্রমাণ নেই:
কুরআনের কোথাও নবিজীর জন্মদিন পালন বা এ বিষয়ে আনন্দ করার বিশেষ নির্দেশনা নেই। যেহেতু নবিজী, সাহাবা বা তাবেয়ীন এ ধরনের উদযাপন করেননি, এটি একটি প্রবর্তিত কাজ হতে পারে। -
আল্লাহ বলেন বিদআতের বিষয়ে সতর্ক থাকুন:
"তারা কি এমন শরীক স্থির করে নিয়েছে, যারা তাদের জন্য দ্বীনের এমন বিষয় প্রবর্তন করেছে, যার অনুমতি আল্লাহ দেননি?"
(সূরা আশ-শুরা: ২১)
→ এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, আল্লাহর নির্দেশ ছাড়া নতুন কোনো ধর্মীয় প্রথা প্রবর্তন করা অনুমোদিত নয়।
২. হাদিসের দৃষ্টিকোণ
হাদিসে নবিজীর জন্মদিন পালনের বিষয়ে সরাসরি কোনো নির্দেশনা বা নিষেধাজ্ঞা পাওয়া যায় না। তবে নিম্নলিখিত হাদিসগুলোকে এ বিষয়ে দলিল হিসেবে ব্যবহৃত করা হয়:
পক্ষে দলিল:
- নবিজী তাঁর জন্মদিন স্মরণ করেছেন:
নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজে তাঁর জন্মদিন স্মরণ করে রোজা রাখতেন।
হাদিস:
আবু কাতাদাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত:
নবিজী (সা.) সোমবারে রোজা রাখতেন এবং বলতেন:
"এই দিনে আমি জন্মগ্রহণ করেছি এবং এ দিনে আমাকে নবুওয়ত দান করা হয়েছে।"
(সহিহ মুসলিম: ১১৬২)
→ এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, নবিজী নিজে তাঁর জন্মদিনকে বিশেষ দিন হিসেবে স্মরণ করতেন।
বিপক্ষে দলিল:
-
নবিজীর যুগে এটি পালিত হয়নি:
নবিজী (সা.), সাহাবা, তাবেয়ীন বা ইমামদের যুগে নবিজীর জন্মদিন উদযাপন করা হয়নি।
→ যদি এটি উত্তম হতো, তবে সাহাবারা অবশ্যই এটি করতেন।
হাদিস:
নবিজী (সা.) বলেন:
"যে ব্যক্তি আমাদের এই দ্বীনে এমন কিছু প্রবর্তন করে যা এর অংশ নয়, তা প্রত্যাখ্যাত।"
(সহিহ বুখারি: ২৬৯৭, সহিহ মুসলিম: ১৭১৮) -
বিদআতের সতর্কবার্তা:
নবিজী (সা.) বলেন:
"প্রত্যেক নব উদ্ভাবন বিদআত, এবং প্রত্যেক বিদআত পথভ্রষ্টতা।"
(সহিহ মুসলিম: ৮৬৭)
→ নবিজীর জন্মদিন পালনের প্রথা তাঁর জীবদ্দশায় ছিল না। এটি পরবর্তীতে প্রবর্তিত হয়, যা বিদআত বলে বিবেচিত হতে পারে।
৩. ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ
-
ইসলামের প্রাথমিক যুগে এটি পালিত হয়নি:
নবিজীর জন্মদিন উদযাপন করার প্রথম দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় ফাতিমি শাসনামলে (৪র্থ হিজরি শতাব্দী)। এটি মূলত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে চালু হয়। -
ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ):
ইবনে তাইমিয়া বলেন:
"যারা নবিজীর জন্মদিন পালন করে, তাদের নিয়ত যদি ভালো হয় এবং তারা যদি ভালো কাজ করে, তবে আল্লাহ তাদের নিয়তের জন্য পুরস্কৃত করতে পারেন। কিন্তু এটি স্পষ্টত বিদআত।"
(ইকতিদা আস-সিরাত আল-মুস্তাকিম)
৪. হানফি মাজহাবের দৃষ্টিকোণ
হানাফি মাজহাবে নবিজীর জন্মদিন পালনের বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো ফতোয়া নেই। তবে নিম্নলিখিত দৃষ্টিকোণ গ্রহণ করা হয়েছে:
-
যদি হারাম কাজ না থাকে:
নবিজীর জন্মদিন স্মরণ করা (যেমন তাঁর জীবনী আলোচনা, দরুদ পাঠ, ইবাদত করা) যদি ইসলামের মূল বিধানের বাইরে না যায় এবং এতে হারাম বা বিদআত না থাকে, তবে এটি জায়েজ হতে পারে। -
ইবাদত মনে না করা:
হানাফি আলেমরা মনে করেন, যদি কেউ এটিকে ইবাদতের অংশ মনে করে বা এটিকে ধর্মীয় আবশ্যিকতা বানায়, তবে এটি বিদআত হয়ে যায়।
উপসংহার:
-
পক্ষে:
নবিজীর জন্মদিনে আনন্দ করা, তাঁর জীবনী আলোচনা, দরুদ পাঠ, এবং দান-সদকা করলে এটি জায়েজ হতে পারে। তবে এটি ইসলামের আবশ্যক বিধান নয়।
-
বিপক্ষে:
নবিজীর জন্মদিন পালনের প্রথা ইসলামের প্রাথমিক যুগে ছিল না। এটি বিদআত হতে পারে যদি এটি নতুন ধর্মীয় উদযাপন হিসেবে চালু করা হয়।
সর্বোত্তম দৃষ্টিভঙ্গি:
- নবিজীর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের প্রকৃত উপায় হলো তাঁর সুন্নাহ পালন এবং ইসলামের আদর্শ জীবনে বাস্তবায়ন করা।
- জন্মদিন পালন নিয়ে আলেমদের মধ্যে মতভেদ থাকায় অন্যদের প্রতি কঠোর হওয়া উচিত নয়।
নোট: সঠিক পথ জানার জন্য বিশ্বস্ত আলেমদের সঙ্গে পরামর্শ করুন।