ইসলামে বিবাহের নিয়ম: সম্পূর্ণ বিস্তারিত আলোচনা।
বিবাহ (নিকাহ) ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান। এটি শুধু একজন পুরুষ ও নারীর মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যম নয়, বরং একটি পবিত্র বন্ধন যা সামাজিক শৃঙ্খলা ও পারিবারিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে। ইসলাম বিবাহকে শুধু একটি চুক্তি হিসেবে দেখেনি, বরং এটি একটি ইবাদতের অংশ এবং আল্লাহর প্রেরিত রাসূল (সা.)-এর সুন্নত।
ইসলামে বিবাহের উদ্দেশ্য
১. নৈতিক পবিত্রতা বজায় রাখা:
পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে:
"আর তাদের মধ্য থেকে এমন পবিত্র নারীদের বিবাহ কর, যারা দাসী হলেও ধর্মপরায়ণ।" (সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৩)
২. পরিবার গঠন ও প্রজন্ম সৃষ্টি:
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
"তোমরা বিয়ে করো, কারণ আমি কেয়ামতের দিন তোমাদের সংখ্যায় গর্ব করব।" (তিরমিজি)
৩. দাম্পত্য সুখ ও সহযোগিতা:
পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে:
"তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে সঙ্গিনী সৃষ্টি করেছেন যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তি পাও।" (সূরা আর-রূম, আয়াত: ২১)
বিবাহের নিয়ম ও শর্তসমূহ
ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী বিবাহ সঠিকভাবে সম্পন্ন করার জন্য নিম্নলিখিত শর্ত পূরণ করতে হবে:
১. ইজাব (প্রস্তাব) ও কবুল (গ্রহণ):
বিবাহের মূল স্তম্ভ হল, কনে ও বর উভয়ের সম্মতিতে প্রস্তাব এবং গ্রহণের মাধ্যমে চুক্তি সম্পন্ন হওয়া।
২. মহর নির্ধারণ:
মহর হলো বর পক্ষ থেকে কনে পক্ষকে প্রদত্ত একটি অর্থ বা উপহার।
- কুরআনে বলা হয়েছে:
"তোমরা নারীদের তাদের মহর খুশিমনে দাও।" (সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৪)
৩. গवाह থাকা:
বিবাহে দুইজন প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিম পুরুষ বা একজন পুরুষ ও দুইজন নারী গवाह থাকা আবশ্যক।
- হাদিসে উল্লেখ রয়েছে:
"গোয়াহ ছাড়া কোনো নিকাহ বৈধ নয়।" (আবু দাউদ)
৪. ওয়ালির অনুমতি:
নারীর পক্ষে তার অভিভাবক (ওয়ালি) বিবাহে সম্মতি প্রদান করবেন।
- রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
"ওয়ালির অনুমতি ছাড়া কোনো বিয়ে বৈধ নয়।" (তিরমিজি)
৫. সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ইসলামের বিধান মেনে চলা:
বর-কনে উভয়ের ইসলাম ধর্ম পালন করা আবশ্যক।
ইসলামে বিবাহের প্রকারভেদ
ইসলামী শরীয়তে বিবাহকে সাধারণত চার প্রকারে বিভক্ত করা হয়েছে। প্রতিটি প্রকার শরীয়তের নির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী বিবেচিত হয়।
১. বৈধ বিবাহ (নিকাহ)
এটি হল সেই বিবাহ যা ইসলামি শরীয়তের শর্ত পূরণ করে।
- বৈধ বিবাহের বৈশিষ্ট্য:
- ইজাব ও কবুল
- গাওহ নির্ধারণ
- ওয়ালির অনুমতি
- মহর প্রদান
দলিল:
কুরআনে আল্লাহ বলেন:
"তোমাদের মধ্যে যারা বিবাহযোগ্য, তাদের বিয়ে করো।" (সূরা আন-নুর, আয়াত: ৩২)
২. মোতার বিবাহ (স্থায়ী বিবাহ)
মোতার বিবাহ হলো এমন বিবাহ যা দাম্পত্য জীবনের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করে না। তবে এটি শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত, কিন্তু সুন্নি ফিকহ এটিকে হারাম বলে মনে করে।
দলিল:
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
"মোতার বিবাহ আমার এবং কেয়ামতের দিন পর্যন্ত হারাম করা হয়েছে।" (মুসলিম)
৩. হারাম বিবাহ (নিষিদ্ধ বিবাহ)
নিম্নলিখিত বিবাহগুলো ইসলামে নিষিদ্ধ:
- নিকট আত্মীয়ের সঙ্গে বিবাহ: পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে:
"তোমাদের মায়ের, বোনের, কন্যাদের সঙ্গে বিবাহ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।" (সূরা আন-নিসা, আয়াত: ২৩)
- মুশরিক বা বিধর্মীর সঙ্গে বিবাহ:
কুরআনে বলা হয়েছে:"মুশরিক নারীদের বিয়ে করো না যতক্ষণ না তারা ঈমান আনে।" (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২২১)
৪. মিসিয়ার বিবাহ (চুক্তিভিত্তিক বিবাহ)
এটি এমন একটি বিবাহ যেখানে কিছু নির্দিষ্ট শর্তের উপর ভিত্তি করে বিবাহ করা হয়। তবে এটি বিতর্কিত এবং অধিকাংশ উলামা এটিকে অনুমোদন করেন না। আহনাফের মতে এটি হারাম।
বিবাহ সম্পর্কিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ হাদিস
১. রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
"তোমাদের মধ্যে যে বিবাহ করতে সক্ষম, সে যেন বিবাহ করে। কারণ এটি দৃষ্টি অবনত রাখে এবং পবিত্রতা বজায় রাখে।" (বুখারি, মুসলিম)
২. সৎ নারীর গুরুত্ব:
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
"চারটি কারণে নারীকে বিয়ে করা হয়: সম্পদ, বংশ, সৌন্দর্য এবং ধর্মপরায়ণতা। তুমি ধর্মপরায়ণ নারীকে গ্রহণ করো, তাহলে তুমি সফল হবে।" (বুখারি, মুসলিম)
ইসলামে বিবাহের সামাজিক গুরুত্ব
১. পরিবারের প্রতিষ্ঠা: বিবাহ ইসলামে একটি পরিবারের ভিত্তি স্থাপন করে।
২. নৈতিক শৃঙ্খলা: এটি মানুষের যৌন প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ করে এবং হারাম সম্পর্ক থেকে দূরে রাখে।
৩. সমাজের স্থিতিশীলতা: বিবাহ সামাজিক বন্ধন মজবুত করে।
উপসংহার
ইসলামে বিবাহ একটি মহান ইবাদত এবং সামাজিক দায়িত্ব। এটি মানুষের ব্যক্তিগত জীবনকে পরিপূর্ণ করে তোলে এবং সমাজে নৈতিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত করে। ইসলামের নির্দেশনা মেনে বিবাহ করলে দাম্পত্য জীবন সুখময় এবং বরকতময় হয়। আল্লাহ আমাদের সঠিক পথে চলার তাওফিক দিন।
(আল্লাহই সর্বাধিক জ্ঞানী এবং প্রজ্ঞাময়।)